আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এই সপ্তাহে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল। স্বীকৃতি দিয়েছে আন্দোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মনাকো। ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে অনেকেই ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিচ্ছেন। তবে বাস্তব পদক্ষেপে অগ্রগতি প্রায় নেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইসরায়েলি পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হবে কি না অনিশ্চিত। জার্মানির মতো দেশগুলোর আপত্তিতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারকে চাপ দেওয়ার প্রচেষ্টা আটকে আছে।
গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছানো সীমিত, যদিও খাদ্যাভাব প্রকট। ফিলিস্তিনি শরণার্থী গ্রহণের ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় দেশগুলো অনিচ্ছুক। আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা সর্বাধিক বেলজিয়ামে, যেখানে তুলনামূলকভাবে শিথিল নীতি ও বড় ফিলিস্তিনি কমিউনিটি রয়েছে। তবুও অনেক আবেদন এ বছর খারিজ হয়েছে।
দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরের ৩৪ বছর বয়সী বাহজাত মাদি ২০২২ সাল থেকে বেলজিয়ামে আছেন। তিনি ২০২৪ সালে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। তার বাবা এখনও গাজায় আটকে আছেন। মাদি বলেন,
আমি আমার বাবাকে জীবিত রাখতে যেকোনও কিছু করতে চাই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
তিনি আদালতে আবেদন করেছেন, যেন দূর থেকে বাবার ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু মানবিক ভিসার জন্য আবেদন করতে হয় জেরুজালেম কনস্যুলেটে, যা গাজার কারো জন্য কার্যত অসম্ভব।
জনমত এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। কিন্তু জার্মানি ও ইতালির মতো দেশগুলো ঐতিহাসিক কারণে বড় পদক্ষেপে নিতে অনিচ্ছুক। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিনা কাউশ বলেন, এত দ্রুত সময়ে এত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আগে দেখিনি। তবে দেখার বিষয় হলো কথার বাইরে বাস্তবে কী ঘটে।
তিনি আরও বলেছেন, এটা শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রশ্ন নয়। ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপাক্ষিকতা রক্ষা করতে পারে কি না সেটির একটি পরীক্ষা।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উদ্যোগে লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম ও ব্রিটেনসহ একাধিক দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের এক কমিশন ইসরায়েলকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছে। তবে ইসরায়েল অভিযোগটিকে ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ বলছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ স্থায়ীভাবে ইসরায়েলে অস্ত্র রফতানি নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি ৭০০ মিলিয়ন ইউরোর রকেট লঞ্চার চুক্তিও বাতিল করেছেন। বেলজিয়াম পশ্চিম তীরের অবৈধ বসতি থেকে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। তবে এসব পদক্ষেপ যুদ্ধের গতিপথে তেমন প্রভাব ফেলেনি।
২০১৫ সালের সিরীয় শরণার্থী সংকট ইউরোপে ডানপন্থার উত্থান ঘটিয়েছিল। সেই স্মৃতি দেশগুলোকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করছে। ফলে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাবে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দ্বিধা স্পষ্ট। অনেক গাজাবাসী সীমান্তের ওপারে মিসরে বা অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছেন।
বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রেভো বলেন, ইউরোপের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না কেন ইউরোপ এত ভীতু।
ইইউ’র অর্থনৈতিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও যৌথ পদক্ষেপ নিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। ইসরায়েল ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৪ সালে তাদের মোট বাণিজ্যের ৩২ শতাংশ ছিল ইইউ’র সঙ্গে।
ইউরোপীয় কমিশন এখন সবচেয়ে বড় পদক্ষেপের কথা ভাবছে। আর তা হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে আংশিক বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত। এর ফলে কয়েক বিলিয়ন ইউরোর বাণিজ্য সুবিধা বাতিল হবে। কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন বলেন, গাজায় যা ঘটছে, তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রস্তাব পাসের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এর জন্য সর্বসম্মতির দরকার নেই। তবে জার্মানি ও ইতালি তাতে বাধা হতে পারে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েলবিরোধী সমালোচনা অনেক সময় ইহুদিবিদ্বেষের অজুহাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইইউ’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী কায়া কাল্লাসও বলেছেন, রাজনৈতিক অবস্থান যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। অর্থাৎ, বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
শক্তিশালী ভাষণ, কড়া নিন্দা ও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঢেউ সবই ইউরোপে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপে এখনও বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ইউরোপ কি শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে, এই প্রশ্ন এখনও অনুত্তরিত।
Your Comment